বাংলাদেশীদের ভারতবিরূপতার স্বরূপ-অরূপ

 বাংলাদেশে ভারতের বিরুদ্ধে জনপ্রিয় অভিযোগ আছে— ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে যতটা নেয়, ততটা দেয় না।



আখতারুজ্জামান আজাদ. স্যাটায়ার বাংলা 

ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশীদের একটা বড় অংশের বিতৃষ্ণা আছে, বাংলাদেশের ব্যাপারে বিতৃষ্ণা আছে অনেক ভারতীয় নাগরিকের। তৃষ্ণা-বিতৃষ্ণার এই খতরনাক খতিয়ান অনেক পুরোনো, অনেক তিক্ত। ভারতীয়দের একাংশ কেন বাংলাদেশের ব্যাপারে অসহিষ্ণু, সে-বর্ণনা এই নিবন্ধে দেওয়া হবে না; দেওয়া হবে বাংলাদেশের যারা ভারতের ব্যাপারে বিরোধিতা বা বিদ্বেষ পোষণ করে, এর স্বরূপ বর্ণনা। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক প্রচণ্ড রকমের বহুমাত্রিক। মোটেই সরলরৈখিক না এই সম্পর্ক। ইচ্ছে হলো, কূটনীতিকদেরকে বের করে দিয়ে পরস্পরের দূতাবাস বন্ধ করে দিলাম; মন চাইল, একে অন্যের ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলাম; মর্জি হলো, এক দেশের সেনাবাহিনী আরেক দেশের সীমান্তে ঢুকে কিছুক্ষণ গোলাগুলি করে কিছু মানুষ মেরে চলে গেল— ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এ-রকম মর্জিমাফিক না। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসের ১৩ তারিখেও ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ নামে আলাদা কোনো দেশ ছিল না; ভারতও কোনো দেশ ছিল না, ছিল ব্রিটেনের উপনিবেশ মাত্র। উপনিবেশ হওয়ার আগেও 'ভারত' নামে কোনো একক দেশের অস্তিত্ব ছিল না। বর্তমান ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলোর একেক অংশ একেক শাসকের অধীন ছিল। ১৪ আগস্ট দেশভাগ হওয়ার পরও ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত দীর্ঘদিন উন্মুক্ত ছিল। যার ইচ্ছে, পাকিস্তান থেকে ভারতে ঢুকেছে; যার ইচ্ছে, ভারত থেকে পাকিস্তানে ঢুকেছে। সীমান্ত বন্ধ হওয়ার পরও ঢোকাঢুকি বন্ধ হয়নি। কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন করা সহজ; জনগণের দুই পাড়ের সম্পত্তির হিশাব-নিকাশ, কাদের কোন আত্মীয় কোন দেশে থাকবে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে গিয়ে আয়ের উৎস কী হবে— এই হিশাব অত সোজা না। কোন দেশে থাকা হবে— গণভোটের মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল সিলেটের জনগণ। কিন্তু বাংলা আর পাঞ্জাবের লোকজন সেই সুযোগ পায়নি। বাংলা-পাঞ্জাবকে টুকরো-টুকরো হয়ে অন্তর্ভুক্ত হতে হয়েছে দুই দেশে। ফলে, ভারতীয় পাঞ্জাবের অনেকের আত্মীয়স্বজনই পাকিস্তানে, পাকিস্তানি পাঞ্জাবের অনেকের আত্মীয়স্বজনই ভারতে। ভারত থেকে নিপীড়িত হয়ে অনেক মুসলমান চলে এসেছেন পূর্ববাংলায়, পূর্ববাংলা থেকে নিপীড়িত হয়ে অনেক হিন্দু চলে গেছেন ভারতে। পূর্ববাংলা 'পূর্ববাংলা' থেকে 'পূর্ব পাকিস্তান' হয়েছে, 'পূর্ব পাকিস্তান' থেকে 'বাংলাদেশ' হয়েছে; কিন্তু পরিমাণে কম হলেও এখনও অব্যাহত আছে নিপীড়িত হয়ে হিন্দুদের বাংলাদেশত্যাগের স্রোত। নিপীড়ন যে-দেশেই হোক, এর পেছনে ধর্মের চেয়েও বেশি কাজ করে রাজনীতি আর অর্থনীতি। কারণ, নিপীড়িত পরিবারটি দেশত্যাগ করলে সেই পরিবারের জমিজমা দখল করা যাবে, সহায়-সম্বল দখল করা যাবে। ধর্ম বা ধর্মানুভূতি এখানে কাঁচামাল মাত্র।


এ-কথা অনস্বীকার্য যে, ভারত-বাংলাদেশের জনগণের একাংশের মধ্যকার বিরূপ সম্পর্কের অন্যতম কারণ ধর্ম। এমন কোনো আমল বা যুগের সন্ধান মেলে না, যে-আমলে বা যে-যুগে এই উপমহাদেশে ধর্মীয় সংঘাত ছিল না। বিপরীতধর্মের প্রতি অনাস্থা-অবিশ্বাস আর ধর্মীয় দাঙ্গার কারণেই সাতচল্লিশে উপমহাদেশ একটা আস্ত দেশ হিশেবে আবির্ভূত হতে পারেনি, আবির্ভূত হতে হয়েছে দুটো ভিন্ন দেশ হিশেবে এবং সাতচল্লিশের দেশভাগই বিশ্বের ইতিহাসে ধর্মের ভিত্তিতে সম্ভবত একমাত্র দেশভাগ। দেশভাগের মাত্র এক বছর আগে ছেচল্লিশেই দুই বাংলায় যত মানুষ ধর্মীয় দাঙ্গায় আহত-নিহত-বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, সেই দাঙ্গার পেছনে ছিল শত-শত বছরের ধর্মীয় বিভেদ। উপমহাদেশে ইসলাম যখন আসেইনি, ধর্মীয় বিভেদ-জাতপাত তখনও ছিল। দেশভাগের বয়স হয়েছে পৌনে একশো বছরের একটু বেশি। শত-সহস্র বছরের ধর্মীয় বিদ্বেষ সাতাত্তর বছরেই মিটে যাবে— এ অসম্ভব। ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মকে আফিমের মতো ব্যবহার আগেও করেছে, এখনও করছে, ভবিষ্যতেও করবে এবং উপমহাদেশে ধর্মীয় হাঙ্গামা ভবিষ্যতেও থাকবে। বাংলাদেশের বাহাত্তরের সংবিধানে অন্যতম মূলনীতি হিশেবে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' থাকলেও, মনে রাখতে হবে— ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে, পূর্ব পাকিস্তানের আবির্ভাব হয়েছিল ধর্মেরই ভিত্তিতে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে মাত্র সাড়ে তিন বছর পর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা আর থাকেনি। সংবিধানে আওয়ামি লিগ পরবর্তীকালে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনলেও বাংলাদেশ আর কখনোই ধর্মনিরপেক্ষ থাকেনি; এমনকি খোদ আওয়ামি লিগও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি করেনি, তিনটি ভুয়া নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য  সর্বশেষ দশ বছর তারা সর্বোচ্চ মাত্রায় মৌলবাদ-তোষণ করেছে। ধর্মের-ভিত্তিতে-স্বাধীন-হওয়া পাকিস্তান থেকে একাত্তরে-দ্বিতীয়বার-স্বাধীন-হওয়া বাংলাদেশের জনগণের একাংশ যে ভারতকে সেরেফ ধর্মের কারণে অপছন্দ করবে এবং ভারতেরও কিছু মানুষ সেরেফ ধর্মেরই কারণে বাংলাদেশকে ঘৃণা করবে; এতে হতাশ হওয়ার অনেক-কিছু আছে, তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এও মনে রাখতে হবে যে, নেপালও হিন্দু-অধ্যুষিত রাষ্ট্র, দীর্ঘদিন ধরে নেপালের রাষ্ট্রধর্ম ছিল হিন্দু। হিন্দুরাষ্ট্র বলে নেপালের প্রতি কোনো বাংলাদেশীর বিন্দুমাত্র বিরোধ বা বিদ্বেষ নেই, আছে ভারতের প্রতি। কেন আছে, তা খুঁজে বের করতে হবে ভারতকেই; সমাধানও করতে হবে ভারতকেই।


ভারতের সাথে যতগুলো দেশের সীমান্ত আছে, এর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ সীমান্ত বাংলাদেশেরই সাথে— চার হাজার ছিয়ানব্বই কিলোমিটার। উইকিপিডিয়ায় উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী— ১৯৭২ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সীমান্তে বিএসএফের হাতে নিহত বাংলাদেশীসংখ্যা এক হাজার আটশো ষাট। উইকিপিডিয়ার তথ্যে যদি বিশ্বাস না-থাকে, তা হলে বলতে হয়— ২০১৯ সালের জুলাইয়ে জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী (বিদেশমন্ত্রী) আবদুল মোমেন তথ্য দিয়েছেন তৎপূর্ববর্তী দশ বছরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশী নিহত হয়েছে দুইশো চুরানব্বইজন। দশ বছরে দুইশো চুরানব্বইজন নিহত হলে আটচল্লিশ বছরে এক হাজার আটশো ষাটজনের নিহত হওয়ার পরিসংখ্যানে ভুল থাকার কথা না। ২০২০-পরবর্তী আমলনামা আর উল্লেখ করলাম না। বিএসএফ কেবল দেখামাত্র গুলিই করে না; সীমান্ত-লাগোয়া কৃষিজমিতে কাজ-করতে-থাকা কৃষকদেরকে অপহরণ করে নিয়ে যায়, চোরাকারবারি সন্দেহে কাউকে-কাউকে ধরে নিয়ে যায়, মুক্তিপণ আদায় করে অনেককে ছেড়ে দেয়, কারো বা হাত-পায়ের নখ তুলে দেয়, মুখে-পায়ুপথে পেট্রোল ঢুকিয়ে নির্যাতন করে, কাউকে হত্যা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্য মরদেহ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখে। দিল্লিতে গৃহকর্মীর কাজ করা বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানি খাতুন সীমান্তের মই বেয়ে দেশে ঢোকার সময়ে কাঁটাতারে জামাকাপড় আটকে গিয়েছিল। ফেলানি ভয়ে চিৎকার দিয়েছিল। বিএসএফ তাকে গ্রেপ্তার করে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারত। কিন্তু বিএসএফ তাকে গুলি করে হত্যা করে এবং মরদেহ পাঁচ ঘণ্টা কাঁটাতারেই ঝুলিয়ে রাখে। কাঁটাতারে ফেলানির ঝুলে থাকার সেই ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারির ছবি পরবর্তী চৌদ্দ বছরে বাংলাদেশে প্রচুর ভারতবিরোধী তৈরি করেছে এবং এই 'প্রচুর ভারতবিরোধী' তৈরি হওয়ার জন্য ভারতই দায়ী। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক সরলরৈখিক না, বহুমাত্রিক— আগেই বলেছি। ভারতে রক্তের স্বজন থাকে— বাংলাদেশে এমন অসংখ্য মানুষ আছেন, যাদের পক্ষে পাসপোর্ট-ভিসার ঝামেলায় যাওয়া সম্ভব না। তাদের কেউ-কেউ দুই দেশের দালালদের যোগসাজশে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে এবং বিএসএফের গুলিতে বেঘোরে প্রাণ হারায়। বিএসএফকে কোনোভাবেই 'শুট অন সাইট' নীতি থেকে সরানো যায়নি। বিএসএফ ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের খামখেয়ালি এবং বাংলাদেশের ধ্বজভঙ্গ পররাষ্ট্রনীতির ফসল তিপ্পান্ন বছরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে দুই-আড়াই হাজার লাশ। বিশ্বের আর কোনো সীমান্তে সম্ভবত এত হত্যাকাণ্ড হয় না। এর বিরুদ্ধে ভারতের কোনো নাগরিককে তেমন-একটা সরব হতে কখনোই দেখিনি। অন্য দেশের সীমান্তরক্ষীবাহিনী পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছরে দুই-আড়াই হাজার ভারতীয়কে হত্যা করলে সেই দেশের প্রতি ভারতীয়দের মনোভাব কেমন হবে— তা ভারতীয়রাই ভেবে দেখুক।


ভারতের প্রতি বাংলাদেশের জনসাধারণের একাংশের বিরূপ মনোভাবের অন্যতম বড় কারণ পানিসমস্যা। দুই দেশের অভিন্ন নদীগুলোর প্রাপ্য পানি ভারত বাংলাদেশকে দিচ্ছে না— বাংলাদেশে এমন অভিযোগ পুরোনো। ভারতের নির্মিত বাঁধের কারণে বাংলাদেশের অনেক প্রমত্তা নদী শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে, বৃষ্টির মৌসুমে অস্বাভাবিক প্লাবন হচ্ছে, বন্যার সময়ে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে না-জানিয়েই ভারত বাঁধের গেট খুলে দেয়— এমন অভিযোগও আছে। সেইসব অভিযোগ সত্য কি না, সত্য হলে কতটুকু সত্য— জানি না। এ-ব্যাপারে সাধারণ কলামলেখকদের মন্তব্য করা সাজে না, এসব সম্পর্কে মন্তব্য করা নদী-বিশেষজ্ঞদের কাজ। বাঁধনির্মাণ যেহেতু ভারত করে; সেহেতু ভারতেরই উচিত বাংলাদেশের প্রাপ্য পানি সুনিশ্চিত করা, উত্থাপিত অভিযোগগুলোর সত্যতা সম্পর্কে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়মিত ব্যাখ্যা দেওয়া, যাতে পানি ইশুতে দুই দেশের জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি না-হয়। কিন্তু বাঁধনির্মাণকারী রাষ্ট্র ভারত এ-ব্যাপারে কখনোই কোনো ব্যাখ্যা দেয় না বা দেয়নি। অথচ, সামান্য ব্যাখ্যাই পারত বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব হ্রাস করতে।


বাংলাদেশে ভারতের বিরুদ্ধে জনপ্রিয় অভিযোগ আছে— ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে যতটা নেয়, ততটা দেয় না। ভারত বাংলাদেশের এক বা একাধিক সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে, কিন্তু প্রাপ্য মাশুল না-দিয়েই ব্যবহার করে বা মাশুল কম দেয়; বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে মালামালপরিবহণ হয়, ভারত সেখানেও বাংলাদেশকে নামমাত্র মাশুল দেয়; বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের রেলকরিডোরপ্রাপ্তি প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, আওয়ামি লিগ সরকারের পতনের পর তা অনিশ্চিত হয়ে গেছে, সেখানেও বাংলাদেশকে যৎসামান্য মাশুল দেওয়ার ব্যাপারটা পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিল; বাংলাদেশ ভারতকে সব ধরনের করিডোর দিলেও ভারত বাংলাদেশকে নেপালে যেতে সামান্য বিশ-ত্রিশ কিলোমিটারের শিলিগুড়ি করিডোর ব্যবহার করতে দেয় না— এমন তথ্যও বাংলাদেশে বহুলপ্রচলিত। তথ্যগুলো সত্য হলে বাংলাদেশের মানুষের ভারতবিরোধিতা নিঃসন্দেহে যৌক্তিক। মিথ্যা হলে— তা কেন মিথ্যা, কীভাবে মিথ্যা; ভারত সরকারের উচিত ছিল এর ব্যাখ্যা বাংলাদেশের মানুষের কাছে নিয়মিতভাবে তুলে ধরা। ভারত সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিলে বাংলাদেশের আমজনতা এতটা ভারতবিদ্বেষ পোষণ না-ও করতে পারত।


বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান অনস্বীকার্য, অভূতপূর্ব এবং অবিসংবাদিত। ভারত একাত্তরে বাংলাদেশের এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে খাইয়েছে-পরিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তির পক্ষে বহির্বিশ্বে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছে, অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারকে নিজেদের মাটিতে কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ দিয়েছে, সেই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন ভারতের অনেক সৈন্য। সেই বাবদ ভারতের প্রতি বাংলাদেশের জনসাধারণের কৃতজ্ঞতার ঘাটতি কোনোকালেই ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের যারা স্বাধীন বাংলাদেশ চায়নি, তাদের হিশাব আলাদা; তারা ভারতকে এমনিতেই জন্মশত্রু মনে করে। কিন্তু যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছে, তাদেরও একাংশ ভারতকে আর নিরঙ্কুশ বন্ধু মনে করতে পারেনি। কেননা, ভারতের অধিকাংশ গণমাধ্যম বাংলাদেশকে নিয়ে লাগামহীন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-অর্জনকে 'ভারতের দান' বলে আখ্যা দেয়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে প্রচার করে 'ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ' বলে। পাকিস্তানও মুক্তিযুদ্ধকে 'ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ' বলে এবং দাবি করে পাকিস্তান রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি, আত্মসমর্পণ করেছে ভারতের কাছে। কৃতিত্ব নিতে গিয়ে ভারতও একই ধরনের দাবি করে। অথচ, ভারতের সহযোগিতা বা হস্তক্ষেপ ছাড়াই বাংলাদেশ দীর্ঘদিন মুক্তিযুদ্ধ করেছে, যুদ্ধে ভারত জড়িত হয়েছে বেশ পরে। ভারত আর পাকিস্তান মুক্তিযুদ্ধকে যে 'ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ' বলে প্রচার করে; তাতে অপমানিত হন ত্রিশ লক্ষ বাংলাদেশী শহিদ, দুই লক্ষ বাংলাদেশী ধর্ষিত নারী, লক্ষ-লক্ষ বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধা। ভারতের অনেক চলচ্চিত্রেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাত্রাতিরিক্ত কৃতিত্ব নিতে গিয়ে ভারত কখন যে বাংলাদেশের জনসাধারণের বিতৃষ্ণা কুড়িয়ে ফেলেছে, ভারত তা টেরই পায়নি। আকারে বড় হলে অনেকেই অনেক-কিছু টের পায় না।


বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যখনই ভারতের কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে যৌক্তিক আলোচনা তোলে, ভারতের অধিকাংশ নাগরিকই তখন মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। এখানে 'স্মরণ করানো' কথাটা ভদ্রতা করেই বললাম। বলা উচিত— বিশ্রীভাবে খোঁটা দেন, ভারত সহযোগিতা না-করলে বাংলাদেশ কখনোই স্বাধীন হতো না বলে-বলে ঔদ্ধত্য দেখান এবং বিভিন্ন অশ্রাব্য গালাগাল করেন। গালাগাল বাংলাদেশীরাও কম করে না— এ-কথাও অনস্বীকার্য। কিন্তু যৌক্তিক অভিযোগ তুললেও মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিয়ে সেই অভিযোগ এড়িয়ে যাওয়া ভারতের প্রতি বাংলাদেশের জনসাধারণের একাংশের মনে স্থায়ী বিরোধ তৈরি করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত একেবারেই নিঃস্বার্থভাবে সহযোগিতা করেছে— এ-কথাও দাবি করার কোনো সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের কী কী স্বার্থ ছিল, সে-আলোচনা এই নিবন্ধের আওতাবহির্ভূত। একাত্তরের পর সাড়ে পাঁচ দশকে গঙ্গা-পদ্মা-যমুনা-ভাগীরথীর পানি অনেক গড়িয়েছে। সাড়ে পাঁচ দশকে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে বারবার চিড় ধরেছে এবং ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা সেই চিড় মেরামত করতে চেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান মনে করিয়ে দিয়ে। বাংলাদেশে যখনই কেউ আওয়ামি লিগ সরকারের সমালোচনা করেছে, আওয়ামি লিগ তাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে 'রাজাকার' ও 'মুক্তিযুদ্ধবিরোধী' তকমা দিয়ে। হরেদরে পাইকারিভাবে ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামি লিগ এত বাজেভাবে নষ্ট করে এ-বছরের ৫ আগস্ট সদলবল ঝাড়ে-বংশে পালিয়েছে যে, এ-দেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের নামও মুখে আনা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। প্রতারিত জনসাধারণের কাছে মুক্তিযুদ্ধ এখন অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক এবং এর পেছনে দায়ী মুক্তিযুদ্ধের অকথ্য অপব্যবহার। মুক্তিযুদ্ধের অতিব্যবহারের ফলে, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামি লিগই যেখানে পলাতক; রাজনৈতিক ঢাল হিশেবে ব্যবহার-পালটা-ব্যবহারের কারণে দুঃখজনকভাবে খোদ মুক্তিযুদ্ধই যেখানে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক; সেখানে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার প্রসঙ্গ তুলে ভারত যদি নিজেদের যেকোনো ধরনের অন্যায়কে জায়েজ করতে চায়, বাংলাদেশে তা হলে ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়বে— সেটিই স্বাভাবিক। ভুলে গেলে চলবে না— ভারত বাংলাদেশের শরণার্থীদেরকে আশ্রয় দিয়েছে পৌনে এক বছর; বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকে আশ্রয় দিয়ে চলছে মুক্তিযুদ্ধেরও আগ থেকে (১৯৭০), চুয়ান্ন বছর ধরে। একাত্তরে বাংলাদেশের জনগণের শরণার্থী হওয়ার পেছনে উপমহাদেশের সাতচল্লিশপূর্ব রাজনৈতিক কূটচাল আছে, ধর্মীয় দাঙ্গা আছে— এ-কথা ভারতীয়দের ভুলে গেলে চলবে না। বাংলাদেশী শরণার্থীরা ফিরে এসেছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কখনোই ফিরবে না। উদ্বাস্তুসমস্যা সারাবিশ্বেই আছে। ভারতেরও এক রাজ্যের মানুষ আরেক রাজ্যে উদ্বাস্তু হয়ে যেতে বাধ্য হয়।


ভারতের কোনো-কোনো গণমাধ্যমে বাংলাদেশকে নিয়ে নিত্য-বিষোদ্‌গার হয়। সেইসব বেধড়ক বীভৎস বিষোদ্‌গারে সভ্যতা-ভব্যতা-ভদ্রতার লেশমাত্র থাকে না। থাকে গয়রহ গুজব, মুহুর্মুহু মিথ্যাচার আর হার্দিক হুমকি। সীমান্ত দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের একদিনের ময়লা ছেড়ে দিলে বাংলাদেশ ভেসে যাবে, ফেনী বরাবর আক্রমণ করে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে হিন্দুরাষ্ট্র কায়েম করা হবে, বাংলাদেশকে ছারপোকার মতো পিষে ফেলতে ভারতের পাঁচ মিনিট লাগবে— এ-জাতীয় অশ্রাব্য কথাবার্তা পশ্চিমবঙ্গের কিছু টেলিভিশন চ্যানেলে হরহামেশা প্রচারিত হয় এবং সেই কথাগুলো বলেন খোদ উপস্থাপকরা। সাধারণ নাগরিকরা চায়ের টঙে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বললে সেটার তাৎপর্য এক রকম, কোনো গণমাধ্যম নিজেদের সাংবাদিকদেরকে দিয়ে এ-ধরনের বক্তব্য দেওয়ালে সেটার তাৎপর্য আরেক রকম। কিছু সর্বভারতীয় পত্রপত্রিকা এবং পশ্চিমবঙ্গের কিছু টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাদেশ নিয়ে এত অসহ্য বক্তব্য প্রচার করে, যা বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেল প্রচার করলে ভারত এতদিনে বাংলাদেশে হয়তো সামরিক আক্রমণও করে বসতে পারত। বিশেষত, বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্টে আওয়ামি লিগ সরকারপতনের পর ভারতের কিছু গণমাধ্যম গুজব ছড়িয়ে এত ন্যাক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছে, তা সাধারণ ভারতীয়দের ধারণারই বাইরে। পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশবিদ্বেষী ঐসব পত্রপত্রিকা ও চ্যানেলের মালিকেরা বিজেপি-নেতা। ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশের লোকজনের বিরূপ মনোভাব তৈরির পেছনে ভারতের উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদী গণমাধ্যমের ভূমিকা সুদূরপ্রসারী। ভারতেরই কিছু-কিছু চ্যানেল, অবশ্য, ঐ উগ্র জাতীয়তাবাদীদের চরিত্র উন্মোচন করে বাংলাদেশের পক্ষেও কথা বলে। ভারতের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদের উচিত হবে ঐসব উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দমন করা, দুই দেশের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে যারা ফায়দা লুটতে চায়— তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনার স্রোত অব্যাহত রাখা।


বাংলাদেশে সংখ্যালঘুনির্যাতন হয়, নির্যাতিত হয়ে ভিটেমাটি ফেলে রেখে দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়, দেশে থেকে গেলেও ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিশেবে বাঁচে— এ-কথা দিবালোকের মতো সত্য। বাংলাদেশে শুভবোধসম্পন্ন যারা আছে, সংখ্যালঘুনির্যাতনের বিরুদ্ধে তাদের সবাই সোচ্চার। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হলে তা ভারতীয়দেরও গায়ে লাগবে, ভারতীয়রাও প্রতিবাদে মুখর হবেন— সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের পেছনে কেবল ইসলামি মৌলবাদই বা মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিই দায়ী না। আওয়ামি লিগ সরকারের আমলেও আওয়ামি লিগের নেতাকর্মীদের দ্বারা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘুনির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে ভারতীয়দেরকে কেন যেন প্রতিবাদমুখর হতে দেখা যায়নি। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুনির্যাতন ইশুতে ভারতীয়দের প্রতিবাদ বরাবরই মৌসুমি। বাংলাদেশে আওয়ামি লিগের আমলে সংঘটিত সংখ্যালঘুনির্যাতনের প্রতিবাদ ভারতের জন্য লাভজনক না। ভারতেও যখন সংখ্যালঘু নির্যাতিত হয়, সেরেফ গরুর মাংস বহনের গুজব তুলে মুসলমানদেরকে পিটিয়ে মারা হয়, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে যখন মুসলমানদের ওপর বুলডোজার-নীতি প্রয়োগ করা হয়, গুজরাটে যখন সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর নিধনযজ্ঞ পরিচালনা করা হয়; বাংলাদেশী সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনে চিন্তিত ভারতীয়দের অধিকাংশকেই তখন আর চিন্তিত হতে দেখা যায় না। কিন্তু ঐসব ঘটনা বিচারের বাইরে থেকে যায় বলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপরও এর প্রভাব পড়ে, নির্যাতন নেমে আসে। উপমহাদেশের রাজনৈতিক চরিত্র কারোই অজানা না। এই উপমহাদেশে এক অঞ্চলে এক ধর্মের লোকজন নির্যাতিত হলে অন্য অঞ্চলে অন্য ধর্মের লোকজনের ওপর নির্যাতনের খড়্‌গ নেমে আসে, এই দোষে বাংলাদেশ একাই দুষ্ট না। এই লেখাটি যখন লিখছি (৬ ডিসেম্বর ২০২৪), এর ঠিক বত্রিশ বছর আগে উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় অন্যায়ভাবে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলেছিল উগ্রবাদী হিন্দুগোষ্ঠী এবং এর রেশ গোটা উপমহাদেশকেই বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ঐ এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশে রক্তপাত কম হয়নি। বাবরি মসজিদ ভাঙার সময়ে হিন্দুত্ববাদীরা স্লোগান দিয়েছিল— 'অযোধ্যা তো ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়।' এরই ধারাবাহিকতায়— এখনও, এই ২০২৪ সালেও, হিন্দু মৌলবাদীরা দাবি করে চলছে— কাশীর জ্ঞানবাপী মসজিদ, মথুরার শাহি ইদগাহ্‌ মসজিদ, সম্ভলের শাহি জামে মসজিদ, আজমিরের মইনউদ্দিন চিশতির দরগাহ্‌, জৌনপুরের আটালা মসজিদ, বদায়ুর শামসি মসজিদ, লক্ষ্ণৌয়ের টিলেওয়ালি মসজিদ, মধ্যপ্রদেশের 'ধার' জেলার কামাল মওলা মসজিদ, কর্ণাটকের বাবা বুদনগিরি দরগাহ্‌ এবং জুম্মা মসজিদ, দিল্লির কুওয়াত-উল ইসলাম মসজিদ-সহ আরো অনেক মুসলমান উপাসনালয়ের জমিতে এককালে হিন্দুধর্মীয় স্থাপনা ছিল এবং এ-সব মুসলমান উপাসনালয় ভেঙে হিন্দুদের কাছে জমি হস্তান্তর করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে সম্ভলের শাহি জামে মসজিদে যখন (২৪ নভেম্বর ২০২৪) জরিপ চলছিল, তখনই সংঘর্ষে মারা গেছেন চারজন মুসলমান। এসব স্থাপনা নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের বাড়াবাড়িতে আরো অনেক হিন্দু-মুসলমান নিহত হবেন এবং এর রেশ ধরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুনির্যাতন চালাবে জামায়াত-শিবির-হেফাজত-খেলাফত। তাই, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুনির্যাতনের প্রতিবাদের পাশাপাশি প্রগতিশীল ভারতীয়দের উচিত হবে এমন ব্যবস্থা করা— যাতে ভারতেও সংখ্যালঘুনির্যাতনের ঘটনা না-ঘটে। অভিযোগ আছে— বিজেপির মতো রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশে মাঝেমধ্যে পরিকল্পিতভাবেই হিন্দুনির্যাতনের ঘটনা ঘটায় ভারতে ভোটের রাজনীতিতে ফায়দা হাসিলের জন্য। বিজেপিকে এই মরণখেলা থেকে বিরত রাখাও প্রগতিশীল ভারতীয়দের কর্তব্য।


তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের কোনো রাজনৈতিক দলই সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সরকার গঠন করতে পারে না; হয় পার্শ্ববর্তী বড় রাষ্ট্রের আশীর্বাদ লাগে, নয় কোনো দূরবর্তী মোড়ল রাষ্ট্রের অনুমোদন লাগে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম না। সরকার গঠন করতে চাইলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে ভারত, চীন, আমেরিকা এবং রাশিয়ার মধ্যকার যেকোনো এক বা একাধিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে অনাপত্তিপত্র আনতে হয়।  আয়তনে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে বাইশ-তেইশ গুণ বড়। ভারতের অন্তত নয়টা রাজ্য আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে বড়। বাংলাদেশের বড় দুই দলের এক দল আওয়ামি লিগ প্রকাশ্যেই ভারতপন্থি। ওপরে-ওপরে কুসুম-কুসুম ভারতবিরোধী হলেও সরকারগঠনের জন্য ভারতের ক্ষমতাসীন দলগুলোর কাছে ভেতরে-ভেতরে আঁতাত করার চেষ্টা করে বিএনপিও। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের রাজনৈতিক প্রভাব থাকা অস্বাভাবিক না। কিন্তু এই প্রভাব প্রায়শই সীমা অতিক্রম করে। উদাহরণস্বরূপ— আওয়ামি লিগ ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে গ্রহণযোগ্যভাবে নির্বাচিত হয়ে এলেও ২০১৪ ও ২০২৪ সালে নির্বাচন করেছে প্রধান বিরোধীদলের (বিএনপি) অংশগ্রহণ ছাড়া এবং ২০১৮-এর নির্বাচনে প্রধান বিরোধীদল অংশ নিলেও আওয়ামি লিগ দেশের ইতিহাসের কুৎসিততম কারচুপির আশ্রয় নিয়ে প্রধান বিরোধীদলকে জিততে দিয়েছে পাঁচটি আসনে (মোট আসন তিনশো)। এই তিনটি ভুয়া নির্বাচনকে সত্যায়িত করেছিল দিল্লি। দিল্লির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থন নিয়েই আওয়ামি লিগ শেষ দশ বছর ক্ষমতায় ছিল। নির্বাচনকে ছেলেখেলায় পরিণত করা আওয়ামি লিগকে ভারত অন্যান্য দেশের ভর্ৎসনা থেকে রক্ষা করেছে কেবল নিজেদের স্বার্থে। এ-বছরের ৫ আগস্ট সেই আওয়ামি লিগ সরকারকে নজিরবিহীনভাবে পালাতে হয়েছে রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের মুখে। যে-আওয়ামি লিগের হাতে লেগে আছে শত-শত ছাত্রজনতার রক্ত; সেই আওয়ামি লিগের অধিকাংশ নেতা এখন প্রমোদবিহার করে বেড়াচ্ছেন ভারতেরই মাটিতে, সেই আওয়ামি লিগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে ভারত সুরক্ষিত দুর্গে ঠাঁই দিয়েছে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায়, সেই আওয়ামি লিগকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করতে তৎপর হয়েছে ভারতেরই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আর গোয়েন্দাসংস্থা। ভারতের কোনো রাজনৈতিক আসামিকে অন্য কোনো দেশ রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় সুরক্ষিত দুর্গে থাকতে দিলে সেই দেশের প্রতি ভারতের আচরণ কী হবে, ভারতীয়দের তা ভেবে দেখা উচিত। বাংলাদেশে আওয়ামি লিগ সরকারের শেষ তিন সপ্তাহে যখন দেশজুড়ে রক্তগঙ্গা বয়ে যাচ্ছিল, এর প্রতিবাদে তখন কোলকাতার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন অল্পকিছু মানুষকে মিছিল করতে দেখা গেছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় বা কোনো রাজ্যসরকারকে এ নিয়ে কিছু বলতে দেখা যায়নি, কেননা আওয়ামি লিগ শেষ দশ বছর কাজ করেছে দিল্লিরই ক্রীড়নক হিশেবে। টানা তিনটা ভুয়া নির্বাচন করা রাজনৈতিক দলকে অন্য একটা দেশ সমর্থন দিয়ে যাবে, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আসামিদেরকে সেই দেশ মর্যাদার সাথে আশ্রয় দেবে; আর সে-দেশটার প্রতি বিদ্বেষ বা বিরোধিতা তৈরি হবে না— এমনটা আশা করা নিশ্চয়ই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। শেখ হাসিনাকে তৃতীয় কোনো দেশে পাঠিয়ে না-দিয়ে দিল্লি এক বিরাট ভুল করেছে। ১৯৭৫-এর পরও শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছিল ভারত, ২০২৪ সালেও দিল। কিন্তু ভারতকে ভুলে গেলে চলবে না— ১৯৭৫ আর ২০২৪ এক না। পঁচাত্তরে হাসিনা ছিলেন নিপীড়িত, চব্বিশে নিপীড়ক।


ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক খারাপ হওয়ার ক্ষেত্রে বিসিসিআইয়ের ক্রিকেটরাজনীতিরও ভূমিকা আছে। ক্রিকেটে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই বাংলাদেশকে টেস্টমর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন বিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি জগমোহন ডালমিয়া। এই বাবদ ভারতের প্রতি বাংলাদেশের সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীদের কৃতজ্ঞতা আছে। আবার এও অনস্বীকার্য যে, বিসিসিআই কোনো রোমান্টিক প্রতিষ্ঠান না, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান; বিনাস্বার্থে বিসিসিআই বা অন্য কোনো দেশের ক্রিকেট বোর্ড কিছুই করবে না। বাংলাদেশকে অকালে টেস্টমর্যাদা দেওয়ার পেছনে বিসিসিআইয়ের স্বার্থ ছিল আইসিসিতে ভারতের ভোটব্যাংক বাড়ানো। টেস্টমর্যাদা পাওয়ার পর দুই যুগ পেরোলেও ক্রিকেটে বাংলাদেশ খুব-বেশি এগোতে পারেনি। ভারতীয় ধারাভাষ্যকাররা এককালে বাংলাদেশকে নিয়ে এত-এত জঘন্য মন্তব্য করতেন, যা বাংলাদেশী ধারাভাষ্যকাররা ভারতকে নিয়ে কখনোই করেননি। সাধারণ দর্শকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা স্টেডিয়ামে প্রতিপক্ষকে নিয়ে কটাক্ষ করলে সেই হিশাব ভিন্ন, এই কটাক্ষ ব্যক্তিগত। কিন্তু টেলিভিশন চ্যানেলে খোদ ধারাভাষ্যকাররা (যারা আবার সাবেক ক্রিকেটারও বটে) অন্য কোনো দেশকে বা সে-দেশের ক্রিকেট নিয়ে কটাক্ষ করলে তা আর ব্যক্তিগত থাকে না, হয়ে পড়ে প্রাতিষ্ঠানিক এবং আনুষ্ঠানিক। ভারতীয় ধারাভাষ্যকারদের অব্যাহত বাংলাদেশবিদ্বেষী তীর্যক মন্তব্যও বাংলাদেশের সাধারণ ক্রিকেটভক্তদের মাঝে ভারতবিরোধিতা তৈরি করেছে, বলতে শিখিয়েছে— 'ভারতের বিরুদ্ধে যদি কোনো কলাগাছও খেলে, তা হলে সেই কলাগাছকেই সমর্থন করব।' সাম্রাজ্যবাদী ও স্বৈরাচারী আচরণের কারণে অন্য কোনো দেশেরই ক্রিকেট বোর্ডের সাথে বিসিসিআইয়ের সম্পর্ক সুখকর না। কোনো একটা বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট হওয়ার আগে বিসিসিআই নির্ধারণ করে দেয় ভারতের খেলাগুলো কবে হবে, কোন-কোন মাঠে হবে। অন্যান্য দলের খেলোয়াড়রা যখন গ্রুপ-পর্বের একেক খেলার জন্য একেক শহরে ভ্রমণ করার ক্লান্তি স্বীকার করে, তখন ভারতীয় খেলোয়াড়রা নির্দিষ্ট একটা মাঠেই গ্রুপ-পর্বের বেশিরভাগ খেলা খেলে ফেলে— এমন নজির এবারকার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই দেখা গেছে। চ্যাম্পিয়ন্‌স ট্রফিতে বিশ্বের অন্য সব দল যখন নির্দিষ্ট একটি দেশে গিয়ে খেলতে প্রস্তুত, তখন বাগড়া বাধিয়ে বসে ভারত। ভারতের জন্য টুর্নামেন্টের স্বাগতিক দেশ পালটাতে হয়, ফিক্‌শ্চার পালটাতে হয়। এইসব সাম্রাজ্যবাদ ঐ দেশ সম্পর্কে অন্য দেশগুলোয় ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করে না। বিজয়ী দলের হাতে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ট্রফি তুলে দেওয়ার কথা ছিল আইসিসির তৎকালীন সভাপতি আ ন হ মুস্তফা কামালের। কিন্তু কামাল বিশ্বকাপে আম্পায়ারিং নিয়ে প্রশ্ন তোলায়, দুর্নীতিবাজ ক্রিকেটপ্রশাসক নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনের কূটচালে, কামালকে বিজয়ী দলের হাতে ট্রফি তুলে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। ট্রফি তুলে দিয়েছিলেন শ্রীনি নিজেই। শ্রীনি এবং বিসিসিআইয়ের এহেন হঠকারিতায় মুস্তফা কামাল আইসিসির সভাপতি-পদ থেকে ইস্তফা নিয়েছিলেন। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এবং ধারাভাষ্যকারদের আচার-আচরণ যেখানে এ-ই, সেখানে ভারতীয়রা যদি আশা করে ক্রিকেটে ভারতের পরাজয়ে অন্য দেশের সমর্থকরা আনন্দিত হবে না— তা নিশ্চয়ই যুক্তিসংগত না। ভারতই ভারতবিদ্বেষের সব আয়োজন সম্পন্ন করে দেয়।


নেপাল-ভারত এককালে ছিল প্রায় অভিন্ন রাষ্ট্র। হিন্দু-অধ্যুষিত দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপাল-ভারত ছিল হরিহর আত্মা। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের কারণে নেপালের অধিকাংশ মানুষ ভারতকে এখন শত্রুরাষ্ট্র হিশেবেই বিবেচনা করে। শ্রী লঙ্কার গৃহযুদ্ধে ভারতের সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণে শ্রী লঙ্কানদের একটা বড় অংশই এখন ভারতবিরোধী। মালদ্বীপের বর্তমান রাষ্ট্রপতি মুহম্মদ মুইজ্জু ক্ষমতায়ই এসেছেন তার ভারতবিরোধী মনোভাবকে পুঁজি করে। নির্বাচনী প্রচারণায়ই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ভোটে জিতলে তিনি ভারতের বলয় থেকে বেরিয়ে এসে চীনা বলয়ে ভিড়বেন, মালদ্বীপের জনগণ তাতে সায়ও দিয়েছে। মালদ্বীপে ভারতবিরোধী মনোভাব এখন তুঙ্গে। দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্রতম দেশ ভুটানের সাথেও ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েন সুস্পষ্ট। চীনা বলয়ের দেশ বিধায় মিয়ানমারের সাথেও ভারতের সম্পর্ক সুখকর না। চীনের সাথে ভারতের যুদ্ধবিগ্রহ তো লেগেই থাকে। পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে একটি বাক্যও ব্যয় করার মানে হয় না। অর্থাৎ এখন একটা প্রতিবেশী দেশের সাথেও ভারতের সম্পর্ক  ভালো না। নিজেদের দেশেও বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। কখনও আসাম স্বাধীন হতে চায়, কখনও মণিপুর, কখনও শিখ-অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে স্বাধীন হতে চায় খালিস্তান। মণিপুরে এই মুহূর্তে চলছে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা-আন্দোলন। শিখদের খালিস্তান-আন্দোলনের নেতা হরজিৎ সিং নিজ্জারকে ভারতীয় গোয়েন্দাসংস্থার কর্মকর্তারা কানাডার মাটিতে খুন করেছেন বলে অভিযোগ আছে। এরই জের ধরে ভারত-কানাডা পরস্পরের কূটনীতিকদেরকে বহিষ্কারও করেছে। হায়দ্রাবাদ আর সিকিমকে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ভারত কীভাবে নিজ ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং সেইসব অভিযানে কত মানুষ হতাহত হয়েছে, তা-ও কারো অজানা না। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম রাষ্ট্র ভারতের ভেতর-বাহির পুরোটাই রাজনৈতিক অস্থিরতায় আক্রান্ত।


ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার পরপর পররাষ্ট্র ইশুতে ভারত 'পঞ্চশীল নীতি' অবলম্বন করত। নীতিগুলো হলো— পরস্পরের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা, পরস্পরের ওপর আগ্রাসন থেকে বিরত থাকা, অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না-করা, সাম্য ও সুবিধা নিশ্চিতকরণ এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। কিন্তু দিন যত গড়িয়েছে, পঞ্চশীল নীতি থেকে ভারত তত দূরে সরে গিয়েছে— অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যাপারে নাক গলিয়েছে এবং যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের ভারতবিদ্বেষের অযৌক্তিক অনেক কারণ আছে— ধর্মীয় বিদ্বেষ আছে, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির বিদ্বেষ আছে, আছে 'শুনেছি ভারত খারাপ, এজন্য ভারত খারাপ' কিসিমের অলৌকিক ভারতবিদ্বেষ। কিন্তু বাংলাদেশীদের ভারতবিরোধিতার পুরোটাই অহেতুক না, কিছু-কিছু হেতু অত্যন্ত যৌক্তিক। 'আমরা পূর্ববঙ্গের এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিলাম, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম, আমাদের সেনারা বাংলাদেশের জন্য জীবন দিয়েছিল; এখন বাংলাদেশীরা কোন স্পর্ধায় ভারতের সমালোচনা করে'— এসব খোঁটা দিয়ে ভারতবিরোধী যৌক্তিক সমালোচনাগুলোকে চিরকাল রুদ্ধ করে রাখার অবকাশ নেই। 'আমরা পেঁয়াজ না-পাঠালে বাংলাদেশ সালুন খেতে পারবে না, আমরা চিকিৎসা না-দিলে বাংলাদেশের রোগীরা বেঘোরে মরবে, আমরা ভিসা বন্ধ করে দিলে কোলকাতার শাড়ি-পাঞ্জাবির অভাবে বাংলাদেশীরা বিয়ে করতে পারবে না'— এসবও শিশুতোষ বক্তব্য। ব্যক্তিপর্যায়ে বা টেলিভিশন চ্যানেলে এ-একম বালখিল্যতার পরিচয় দেওয়া যায়। দু-দেশের কেন্দ্রীয় সরকার আমদানি-রপ্তানি কখনোই বন্ধ করবে না, কেননা আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ন-মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন, ব্যক্তিগত বা ধর্মীয় বচসার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্র কখনও এমন সিদ্ধান্ত নেয় না। পাড়া-মহল্লার ঝগড়াঝাটিবশত ভারত-বাংলাদেশ সরকারও কখনোই আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করবে না, ছিন্ন করবে না কূটনৈতিক সম্পর্ক। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার দিল্লির জন্য পরাজয়স্বরূপ। দিল্লি কখনও ভাবতেই পারেনি বাংলাদেশের সরকার দিল্লির নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকবে। বাংলাদেশীদের জন্য ভিসা বন্ধ রাখায় ভারতের যে-ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হচ্ছে, তাদের চাপে ভিসাও অচিরেই উন্মুক্ত হয়ে যাবে। দিনের শেষে সবকিছু ফের স্বাভাবিক হয়ে আসবে— 'রিপাবলিক বাংলা'র সাংবাদিকদের চট্টগ্রামদখলও হবে না, বাংলাদেশের তৌহিদি জনতার গজওয়াতুল হিন্দও কায়েম হবে না, সে-কালের বৃদ্ধ রাজাকার আর এ-কালের জোয়ান রাজাকারদের খেলাফতপ্রতিষ্ঠাও হবে না, লুৎফুজ্জামান বাবরদের সেভেন সিস্টার্স স্বাধীন করে দেওয়াও হবে না, গণভবন দখল করে আত্মবিশ্বাসে টগবগ করতে থাকা শাড়িচোরদের শিলিগুড়ি বরাবর ভারতের 'চিকেন্‌স নেক'ও ভেঙে দেওয়া হবে না, হবে না বাংলাদেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীবাহিনী মোতায়েন, সফল হবে না উগ্রবাদী শুভেন্দু অধিকারীদের ইউনুস-পতন আন্দোলন কিংবা হাসিনা-পুনর্বাসনপ্রক্রিয়া।


দল বদলায়, নেতা বদলায়, সরকার বদলায়; দেশ সহজে বদলায় না, দেশ বদলায় শতাব্দীতে-সহস্রাব্দীতে দু-একবার করে। ভারত কখনোই বাংলাদেশ আক্রমণ করবে না, বাংলাদেশ কখনও হায়দ্রাবাদ বা সিকিম হবে না। বাংলাদেশ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে বন্ধুত্বও বজায় রাখবে, সদ্‌ভাবও জারি রাখবে, কথাও বলবে চোখে চোখ রেখে। বাংলাদেশের এই উত্তুঙ্গ উত্থান ভারতীয়দেরকে আপাত-অবাক করলেও ভারতীয়দের তা মেনে নিতে শিখতে হবে। বাংলাদেশকে অঙ্গরাজ্য, করদ রাজ্য বা ছোটভাই মনে না-করে সমমর্যাদাসম্পন্ন দেশ ভাবা শিখতে হবে ভারতকে। বাংলাদেশের কিছু নাগরিক ভারতকে কেন অপছন্দ বা অবিশ্বাস করে, ভারতকে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উপলব্ধি করতে হবে এবং তা সমাধানে তৎপর হতে হবে। দুই দেশের বুদ্ধিজীবীদেরকে কাজ করতে হবে সেতুবন্ধন হিশেবে, গণমাধ্যমকে বন্ধ করতে হবে অহেতুক উসকানিপ্রদান। দুই দেশের উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোকে দমন না-করলে দিন-দিন অশান্তি বাড়তেই থাকবে। যদি দুই দেশের জাতীয় সংগীত বাজিয়ে লেখা শেষ করার সুযোগ থাকত, তা হলে তা-ই করতাম। দুই দেশের জাতীয় সংগীত লিখেছেন একই ব্যক্তি— এমন নজির বিশ্বে একটাই আছে, এমন কবিও বিশ্বে একজনই আছেন। সেই বুড়ো কবি লিখে গেছেন— 'পাঞ্জাব, সিন্ধু, গুজরাট, মারাঠা, দ্রাবিড়, উৎকল, বঙ্গ; বিন্ধ্য, হিমাচল, যমুনা, গঙ্গা, উচ্ছল জলধিতরঙ্গ।' এখানে উল্লিখিত বঙ্গে পূর্বও নেই, পশ্চিমও নেই। এই বঙ্গ শুধুই বঙ্গ।


৬ ডিসেম্বর ২০২৪

নবীনতর পূর্বতন